• বুধবার, ১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪২৯

নির্বাচন

উপজেলা নির্বাচন

চাপে ন্যুব্জ চেয়ারম্যান প্রাথীরা

  • প্রকাশিত ১৯ এপ্রিল ২০২৪

মো. বাবুল আক্তার বাবর:

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়েছিল। উপজেলা নির্বাচন ঘিরে এই সংকট আরও ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। দলের ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে এমপিদের স্ত্রী, সন্তান, ভাই-ভাতিজা, শ্যালক, মামা-ভাগনেসহ আত্মীয়স্বজন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, ‘এমপি লীগের’ দাপটে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন অনেক প্রার্থী।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে একজন চেয়ারম্যান প্রার্থী আক্ষেপ করে বলেন- ‘ভাই! আর পারি না। ১৫ বছর দলের নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে এমপি সাহেবরা ব্যস্ত নিজেদের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, ভাই-ভাতিজা, শ্যালক, ভগ্নিপতি, মামা, ভাগ্নে, বেয়াইসহ স্বজন ও অনুগতদের নিয়ে। এক জনকে বানিয়েছেন মেয়র, আরেক জনকে বানাতে চাচ্ছেন উপজেলা চেয়ারম্যান, আরেক জনকে দিয়েছেন দলের দেখভালের দায়িত্ব। এখানে দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতাকর্মীরা মূল্যহীন। যেখানে এমপি সাহেবরা দলের হাইকমান্ডের নির্দেশনা না মেনেও বহাল তবিয়তে আছেন, সেখানে আমরা যে কত নির্যাতিত ও অবহেলিত সেটা বুঝে নেন।

অপর একজন প্রার্থী বলেন, সারা দেশের ৫০টি উপজেলা আওয়ামী লীগের ৬০ জন ত্যাগী নেতা উপজেলা নির্বাচনে 'এমপি লীগ'এর দ্বারা প্রতিনিয়ত ত্যাগী নেতাকর্মীদের সঙ্গে তু-তাচ্ছিলের শিকার হচ্ছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার মিলছে না। এ কারণে দল ক্ষমতায় থাকার পরও বাধ্য হয়ে নির্যাতন সহ্য করছেন অনেক নেতা।

অন্য এক প্রার্থী বলেন, ত্যাগের বিনিময়ে শুধুই পেলাম বঞ্চনা। এ নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মতো দলের নেতাকর্মীকে ঘায়েল করা হচ্ছে। তাদের দাপটে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হতে হয়েছে।

উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপে একেক এলাকায় একেক ধরনের সীমাবদ্ধতা থাকলেও বিশেষ করে ১২টি উপজেলায় প্রকাশ্যে কাজ করছেন মন্ত্রী-এমপি। তারা নিজেদের স্বজন, শুভানুধ্যায়ী ও অনুসারীদের মাঠে নামিয়েই থামছেন না, অন্য প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণায় হস্তক্ষেপ করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিনটি উপজেলার প্রার্থীর ভাষ্য, কেন্দ্রীয় নির্দেশের সঙ্গে এলাকার কোনো মিল নেই। কেন্দ্র এক ধরনের কথা বলেন, আবার স্থানীয় প্রভাবশালীরা অন্য কথা বলেন। এতে করে দলীয় কোন্দলে জয়ী হয়ে যাবে অন্য দলের কেউ।

মাদারীপুরের সদর উপজেলায় প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শাজাহান খানের বড় ছেলে আসিবুর রহমান খান। এ বিষয়ে শাজাহান খান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, একটি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হয়ে সে রাজনীতিতে আসতেই পারে।

টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক তার খালাতো ভাই হারুনার রশীদ হীরাকে আবারও প্রার্থী করার ঘোষণা দেওয়ার অভিযোগ আছে। এ নিয়ে স্থানীয় নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রে অভিযোগ পাঠিয়েছেন।

সম্প্রতি নেত্রকোনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন তার উপজেলা পূর্বধলায় একজন ব্যবসায়ী ও বিএনপির সাবেক নেতা আসাদুজ্জামান নয়নকে নিজের সমর্থন জানিয়েছেন এমন অভিযোগ উঠেছে। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

নাটোরের সিংড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের শ্যালক। যদিও পলক জানিয়েছেন, তিনি কোনো প্রার্থীকে সমর্থন দেননি। এদিকে রুবেল প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় ওই এলাকার অন্য প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী প্রচার কার্যক্রম বন্ধ রেখেছেন।

নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলা নির্বাচনে আতাহার ইশরাক সাবাব চৌধুরীকে প্রার্থী করার ঘোষণা দিয়েছেন তার বাবা স্থানীয় সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী। এ বিষয়ে একরামুল করিমের ভাষ্য, তার বয়স হয়ে গেছে। ছেলে উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে সে সব দাবি সে পূরণ করবে বলেও জানিয়ে দেন।

একই জেলার হাতিয়া উপজেলায় প্রার্থী হচ্ছেন নোয়াখালী-৬ আসনের এমপি মোহাম্মদ আলীর ছেলে আশিক আলী। তাদের বিষয়েও স্থানীয় আওয়ামী লীগে ক্ষোভ আছে।

মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় প্রার্থী হচ্ছেন স্থানীয় এমপি ও সাবেক মন্ত্রী শাহাব উদ্দিনের ভাগনে সোয়েব আহমদ। নরসিংদীর পলাশে স্বতন্ত্র এমপি আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপের শ্যালক শরীফুল হক প্রার্থী হয়েছেন। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীতে এমপি মাজহারুল ইসলাম সুজনের দুই চাচা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য সফিকুল ইসলাম প্রার্থী হয়েছেন। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলায় নির্বাচন করবেন এমপি আলী আজগর টগরের ভাই আলী মুনসুর বাবু। বগুড়া-১ আসনের এমপি সাহাদারা মান্নানের ছেলে শাখাওয়াত হোসেন সজল ও ভাই মিনহাদুজ্জামান লিটন প্রার্থী হয়েছেন বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের এমপি মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লব ও তার পরিবারের চাপে সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দেননি বলে অভিযোগ করেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফসারউদ্দিন ভূঁইয়া। তিনি বলেন, তার জনসমর্থন ছিল; কিন্তু প্রার্থী না হতে তাকে নানামুখী চাপ দেওয়া হয়। ফলে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি মনোনরনপত্র জমা দেননি। এ উপজেলায় মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া একমাত্র প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান আনিছুজ্জামান। তিনি সম্পর্কে এমপির আপন চাচা।

বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলা নিয়ে গঠিত বগুড়া-১ আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের সাহাদারা মান্নান। এই দুই উপজেলার মধ্যে সারিয়াকান্দিতে সাহাদারা মান্নান তার ছেলে সাখাওয়াত হোসেন সজলকে এবং সোনাতলায় ছোট ভাই মিনহাদুজ্জামানকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। তার এই ঘোষণায় স্থানীয় নেতাদের একটি অংশ ক্ষুব্ধ। সজলকে প্রার্থী না করতে উপজেলার ১২ ইউনিয়নের মধ্যে ১১ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন।

এদিকে দলের মন্ত্রী সংসদ সদস্যদের সন্তান, পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের উপজেলা ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ইতিমধ্যে দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকেরা নিজ নিজ বিভাগের মন্ত্রী সংসদ সদস্যদের দলের এই নির্দেশ জানাতে শুরু করেছেন। এরপরও কেউ ভোট থেকে সরে না দাঁড়ালে বহিষ্কারসহ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের দপ্তর এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। দলের সভাপতি শেখ হাসিনার বরাত দিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাঁদেরকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। তাঁরা নিজ নিজ বিভাগে বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন।

এবার চার ধাপে হবে দেশের ৪৮১টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। প্রথম ধাপের ভোট গ্রহণ আগামী ৮ মে অনুষ্ঠিত হবে। ইতিমধ্যে প্রথম ধাপে ১৫২টি ও দ্বিতীয় ধাপে দেশের ১৬১টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তপসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ২১ মে দ্বিতীয় ধাপের ভোটগ্রহণ হবে। আওয়ামী লীগের দলীয় এই নির্বাচনে প্রার্থিতা উন্মুক্ত রেখেছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads